বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
ধর্ষণ নারীদের কাছে এক আতংকের নাম। পত্রিকার পাতা খুললেই মেলে ধর্ষণের খবর। ধর্ষণ প্রমাণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ষণের শিকার নারীর শরীর৷এর জন্য ধর্ষণের ঘটনার পর যে অবস্থায় আছেন তেমনি থাকুন, নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করবেন না। কারণ ধর্ষণকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর শরীরে কিছু প্রমাণ চিহ্ন রেখে যায়। ডাক্তারী পরীক্ষার দ্বারা নারীর শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আলামত সংগ্রহ করা যায়, যা ধর্ষণ প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ঘটনার সময় যে কাপড় গায়ে ছিলো অবশ্যই সংরক্ষণ করবেন৷ কাগজের ব্যাগে করে এই কাপড় রেখে দিন৷ কাপড়ে রক্ত, বীর্য ইত্যাদি লেগে থাকলে তা যদি ধর্ষণকারীর রক্ত বা বীর্যের সাথে মিলে যায়, তাহলে মামলায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে কাজ করে। দ্রুত থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার নিকটবর্তী থানায় এজাহার বা অভিযোগ দায়ের করুন। যদি সম্ভব হয় তবে একজন আইনজীবীকে সাথে নিতে পারেন। পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে চেষ্টা করুন। যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনিই মামলার প্রধান সাক্ষী হতে পারেন। তাঁর জবানবন্দি পুলিশকে গ্রহণ করতে হবে। তবে কোনো ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি বাধ্য নন। অবশ্যই নির্ভরযোগ্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান।
ঘটনার সময়ের আপনার পরিধেয় কাপড় ও অন্যান্য সাক্ষ্য সাথে রাখুন। কারণ এসবই পুলিশ অফিসারের তদন্তের সময় কাজে লাগবে৷ আপনি চাইলে ঘটনা সম্পর্কে মহিলা পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করেত পারেন। থানায় অভিযোগ দায়েরের পর যদি পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহন না করেন তবে অতিদ্রুত পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (এস.পি অথবা ডি.সি ) কে লিখিতভাবে অবহিত করুন। ঘটনার দিনের মধ্যে যদি তারাও কোন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন না করে তাহলে পরের দিন অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে কিংবা সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করুন। এ ব্যাপারে শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ নারী নয়, তার পক্ষ থেকে যে কেউই (যিনি অপরাধ সম্পর্কে জানেন) এ অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনি যত তাড়াতাড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করবেন, তত তাড়াতাড়ি পুলিশ কর্মকর্তা আপনাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন। কারণ ধর্ষণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তারী পরীক্ষা না করালে ধর্ষণের প্রমান পাওয়া যায় না। ডাক্তারী পরীক্ষা সরকারী হাসপাতালে বা সরকার কর্তৃক এই ধরনের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোন বেসরকারী হাসপাতালে সম্পন্ন করা যাবে। ডাক্তারী পরীক্ষা হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার অতিদ্রুত সম্পন্ন করবেন এবং ডাক্তারী পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করবেন৷ ডাক্তারী রিপোর্ট দ্রুত হাতে পেলে পুলিশ দ্রুত ঘটনার তদন্ত শুরু করতে পারবেন। চিকিৎসককে সব কথা খুলে বলতে হবে দ্বিধা না করে চিকিৎসক যা যা জানতে চাইবেন তার সঠিক জবাব দিন। কারণ আপনার কথার ওপর নির্ভর করে তিনি আপনাকে সাহায্য ও সেবা দেওয়ার চেষ্টা করবেন৷ আপনার মানসিক অবস্থার কথাও তাকে জানান। আপনার পরবর্তী মাসিক যদি সময় মত না হয় তবে সাথে সাথেই চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে ভুলবেন না।
ধর্ষণ যদি সম্মতিবিহীন হয় তবে ধর্ষিতা মেয়ের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তার পরিহিতা কাপড়ে ছেড়া ফাটা থাকা স্বাভাবিক। ধর্ষনের সময়ে জোর জবরদস্তি করে পুরুষাংগ গোপনাংগে প্রবেশ করানোর ফলে এবং মেয়ে যদি নব্য যৌবনপ্রাপ্ত কিংবা ইতিপূর্বে সহবাসের অভিজ্ঞতাহীন হয়ে থাকে এবং গোপনাংগে কমপক্ষে দুইটি আংগুল প্রবেশ করাতে কষ্ট সাধ্য কিংবা সরু গোপনাংগ হয়ে থাকে তবে ঐুসবহ ৎঁঢ়ঃঁৎব হয়ে গোপনাংগ দিয়ে রক্ত বের হবে এবং সেই রক্ত কাপড়ের নিচভাবে পরিলক্ষিত হবে। সম্মতিহীন বা সম্মতি সূচক ধর্ষণ উভয় ক্ষেত্রে বীর্যের দাগ শাড়ী বা পেটিকোর্টের উপরিভাগে পরিলক্ষিত হবে। যদি এমন হয় যে, ধর্ষণের সময় মেয়ের পরনে কোন কাপড় ছিল না অর্থাৎ উলংগ অবস্থায় ধর্ষণ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে রক্ত ও বীর্যের দাগ যেই স্থানে বা যে অবস্থানে ধর্ষণ করা হয়েছে সেই স্থানে বা অবস্থানে পড়বে। সেই চিহ্নিত স্থান বা অবস্থান পুলিশকে দেখাতে হবে যাতে পুলিশ আলামত সংগ্রহ করে বিচারে ব্যবহার করতে পারে।
অনেকেই ভেবে থাকেন ডাক্তারি পরীক্ষা বা চিকিৎসা অনেক খরচের ব্যাপার। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মেডিকেল পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হবে এবং তা বিনামূল্যে দিতে হবে। পরবর্তী চিকিৎসাও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে হবে। প্রথমেই ধর্ষিতা পুলিশের কাছ থেকে সব রকম সহায়তা পাওয়ার অধিকারী। জেলা জজের আওতায় প্রতিটি জেলায় আইন সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে আবেদন করলে ভিকটিম আর্থিক অথবা আইনজীবীর সহায়তা পেতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। থানায় এবং হাসপাতালে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে’ আইনগত ও চিকিৎসা পেতে পারেন।
আরেকটি বিষয়ে সোচ্চার হোন কখনো কোনো ধর্ষণের ঘটনায় আপস-মীমাংসা করা যাবে না। কারণ ধর্ষকের পরিচয় সে একজন ধর্ষক। তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। আজকে আপনি তার সঙ্গে আপস করলে সে কালকেই আরেকজনকে ধর্ষণ করবে। কোনোভাবেই কোনো ধর্ষককে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সে নানা রকম ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন সে অপরাধী তার শক্তি কোনোভাবেই আপনার চেয়ে বেশি নয়।
আইনের ভাষায়, নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। সনাক্তকৃত আলামত অভিযুক্তের কি-না তা প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে ধর্ষণ কিংবা এসিড বা এ জাতীয় অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ডাক্তারী পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংসতার শিকার কোনো নারী ও শিশু যে কোনো সরকারী স্থাপনায় কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে যথানিয়মে পরীক্ষা করবেন এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করাসহ, যাকে পরীক্ষা করবেন তাকেও ১ কপি প্রদান করবেন। চিকিৎসক ও তার ক্লিনিক্যাল সহকারীরা নির্যাতনের নারী বা শিশুকে যথাসাধ্য সেবা দেবেন।
কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হয় এ নির্দেশনা মোটেই অনুসৃত হচ্ছে না। প্রথমত, নির্যাতনের শিকার কেউ হাসপাতালে গেলে থানার রেফারেন্স ছাড়া কর্তব্যরত ডাক্তার মেডিকেল পরীক্ষা করতে রাজি হন না। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করছেন ‘তাকেও’ মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ করা হয় না। এর কোনো কারণই সুস্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ছাড়া উপজেলা বা আর কোথাও এই পরীক্ষা করা হয় না।
তবে ‘নির্যাতনের শিকার বা তার পরিবারে কারও হাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা কেন সম্ভব নয়- এ ধরণের প্রশ্নে ডাক্তারদের স্পষ্ট জবাব ‘ আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?’ অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে গেলে, তিনি ধরে নিচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবেন। তাহলে কে বা কারা এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
তবে আইন বলছে, মেডিকোলিগ্যাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা হাসপাতালের আরএমও এবং মেডিকেল অফিসার ও নির্দিষ্ট কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে তো আছেই, এমনি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে। উপজেলা পর্যায়ে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার উপকরণও আছে। সুতরাং এ জাতীয় পরীক্ষা উপজেলা হাসপাতাল থেকে করে সার্টিফিকেট দিতে আইন বাধা তো নেই-ই, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে দেশের সরকারী চিকিৎসালয়গুলোতে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অন্যান্য ছুটির দিন এবং কর্মদিবসগুলোতে দুপুর ২টার পর কোনো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যায় না, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তো দূরের কথা। গ্রাম পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দূরত্ব, যানবাহন, অর্থ সংকট ইত্যাদি কারণে এবং বহুদূর থেকে জেলা সদরে এসে হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে ডাক্তারী পরীক্ষা সময়মতো একেবারেই সম্ভব হয় না। ফলে স্বভাবতই নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধ উৎসাহিত হয়। আমরা আশা করতে চাই, আইন, নীতিমালা, নির্দেশনা, অবকাঠামো ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে ডাক্তার, পুলিশ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। ধর্ষিতারা যেনো সঠিক বিচার পায়-এই হোক প্রত্যাশা।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮